অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের আশা-হতাশার কাহিনি: প্রতিশ্রুতি, বাস্তবতা ও আন্দোলনের পথ
ভূমিকা
অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকারা দেশের গ্রামীণ স্বাস্থ্য, শিশু ও মাতৃকল্যাণ ব্যবস্থার এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু তাদের জীবনের সংগ্রাম, দাবি-দাওয়া এবং দীর্ঘদিনের বঞ্চনা আজও একই রকম রয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যেকটি জেলা তারা ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন।
এই পোস্টে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব—
- মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোবাইল ফোন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি কেন বাস্তবায়িত হলো না
- কেন্দ্র সরকারের বেতন বৃদ্ধি সংক্রান্ত ঘোষণা বনাম পশ্চিমবঙ্গের বাস্তব অবস্থা
- গুজরাট হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়
- অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের ন্যায্য দাবি
- বিভিন্ন রাজ্যের তুলনামূলক পরিস্থিতি
- ভবিষ্যতের আন্দোলনের পথ
মুখ্যমন্ত্রীর মোবাইল ফোন ঘোষণার প্রতিশ্রুতি বনাম বাস্তবতা
কিছু দিন আগে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে রাজ্যের প্রতিটি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাকে বিনামূল্যে একটি করে মোবাইল ফোন দেওয়া হবে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল—
- কেন্দ্রীভূত তথ্যপ্রবাহ
- শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য নথিভুক্তকরণ
- বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের তথ্য দ্রুত আপডেট করা
কিন্তু বাস্তবে সেই মোবাইল ফোন আজও অধিকাংশ কর্মীর হাতে পৌঁছায়নি। ঘোষণার পরেও বরাদ্দ, বাজেট বা প্রশাসনিক জটিলতার কারণে প্রকল্পটি অগ্রগতি পায়নি। ফলে প্রতিশ্রুতির সাথে বাস্তবের দূরত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে।
কেন্দ্র সরকারের ঘোষণা ও বেতন বৃদ্ধির দাবির অমিল
কেন্দ্র সরকার বহু আগেই ঘোষণা করেছিল যে দেশের প্রতিটি রাজ্যে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের বেতন বৃদ্ধি করা হবে। অনেক রাজ্যে তা বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এখনো সেই ঘোষণা কার্যকর হয়নি।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের মাসিক ভাতা প্রায় ৮০০০–৯০০০ টাকা এবং সহায়িকাদের ৪৫০০–৫০০০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। অন্যদিকে, অনেক রাজ্যে এটি ১০,০০০ থেকে ২০,০০০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
গুজরাট হাইকোর্টের ঐতিহাসিক নির্দেশ
সম্প্রতি গুজরাট হাইকোর্ট একটি ঐতিহাসিক রায় দেয়, যেখানে বলা হয় যে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের ন্যায্য বেতন বৃদ্ধি করতে হবে। আদালতের বক্তব্য ছিল—
- তারা দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অন্যতম স্তম্ভ
- তাদের কাজ কোনোভাবেই ‘সেচ্ছাসেবী’ হিসেবে সীমাবদ্ধ নয়
- রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের পর্যাপ্ত আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
গুজরাট হাইকোর্ট অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী (AWWs) ও সহায়িকা (AWHs)-দের জন্য ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে।
আদালত নির্ধারণ করেছে যে তাদের ন্যূনতম মাসিক ভাতা বহুগুণ বাড়ানো হবে।
- কর্মীদের জন্য: ২৪,৮০০ টাকা
- সহায়িকাদের জন্য: ২০,০০০ টাকা
এর আগে কর্মীরা মাসে মাত্র ১০,০০০ টাকা এবং সহায়িকারা ৫,৫০০ টাকা পেতেন। ফলে এই নতুন রায় কার্যকর হলে তাদের আর্থিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে।
এই রায়ের ফলে গুজরাটে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। ফলে অন্যান্য রাজ্যের কর্মীদের মধ্যেও একই ধরনের রায়ের প্রত্যাশা জেগেছে।
অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের দাবি
অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের দীর্ঘদিনের দাবি খুব স্পষ্ট:
- ন্যায্য বেতন—কমপক্ষে ১৮,০০০ টাকা মাসিক ভাতা কর্মীদের জন্য এবং ১২,০০০ টাকা সহায়িকাদের জন্য।
- সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা—তাদের কাজকে ‘অস্থায়ী’ নয়, বরং স্থায়ী চাকরি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
- পেনশন সুবিধা—অবসরের পরেও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
- সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তি—স্বাস্থ্যবিমা, জীবনবিমা, দুর্ঘটনা বিমা।
- প্রযুক্তিগত সুবিধা—প্রত্যেকের হাতে স্মার্টফোন ও ট্যাব দেওয়া, যাতে কাজ সহজ হয়।
অন্যান্য রাজ্যের তুলনা
- গুজরাট: হাইকোর্টের নির্দেশে বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি।
- পাঞ্জাব: অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের আন্দোলনের চাপে ভাতা বৃদ্ধি হয়েছে।
- কেরালা: এখানে কর্মীদের কাজের মর্যাদা তুলনামূলক বেশি স্বীকৃতি পেয়েছে।
- পশ্চিমবঙ্গ: এখনো প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতার মধ্যে তফাৎ বজায় আছে।
কেন পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন জোরদার হচ্ছে
- প্রতিশ্রুত মোবাইল ফোন না পাওয়া
- কেন্দ্র ঘোষিত বেতন বৃদ্ধি কার্যকর না হওয়া
- অন্যান্য রাজ্যে সুবিধা বৃদ্ধি হলেও পশ্চিমবঙ্গে এখনতা কিছুই হয়নি
- রাজনৈতিক আশ্বাসে আস্থা কমে যাওয়া
- দীর্ঘদিনের অবহেলা ও বঞ্চনা
এই সব কারণে পশ্চিমবঙ্গে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে এবং বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলনে নামছে।
আন্দোলনের ভবিষ্যৎ পথ
- আইনি লড়াই: গুজরাট হাইকোর্টের রায় পশ্চিমবঙ্গেও নজির হতে পারে।
- একতাবদ্ধ আন্দোলন: সমস্ত জেলার কর্মীদের একত্রিত হয়ে বড় আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।
- জনসমর্থন: জনগণকে বোঝানো যে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা শুধু শিশুদের নয়, পুরো সমাজের উন্নতির জন্য কাজ করেন।
- রাজনৈতিক চাপ: সরকারকে বাধ্য করতে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা।
উপসংহার
অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকারা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যে ভূমিকা পালন করেন তা অমূল্য। কিন্তু প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবতার ফারাক তাদের হতাশ করছে। পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর মোবাইল ফোন বিতরণ থেকে শুরু করে কেন্দ্র সরকারের বেতন বৃদ্ধি ঘোষণা—সবই এখনো স্বপ্নের মতো রয়ে গেছে।
গুজরাট হাইকোর্টের রায় প্রমাণ করেছে যে ন্যায্য দাবি পূরণের জন্য আইনি পথও একটি বড় হাতিয়ার হতে পারে। তাই পশ্চিমবঙ্গেও প্রয়োজন—একতাবদ্ধ আন্দোলন, আইনি পদক্ষেপ এবং সমাজের সমর্থন।
অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের লড়াই কেবল তাদের বেতন ও সুবিধার জন্য নয়, বরং একটি ন্যায়সঙ্গত ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য।